chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

জলে ভাসা পাতিলে ওদের যেতে হয় বিদ্যালয়ে

ওদের গন্তব্য স্কুল।কিন্তু , হাতে পাতিল দেখে আবাক হবারি কথা । কিন্তু সেই পাতিলের মধ্যে বই-পুস্তক ও স্কুলের পোশাক।জান্নাত-নাসরিনদের সঙ্গে কিছু দূর যেতেই বোঝা গেল, পাতিলটি ওদের কতটা জরুরি। স্কুলে যাওয়ার পথেই ২০০ ফুট চওড়া খাল। সেই খাল পাড়ি দিতে হয় পাতিলে ভেসে। সঙ্গে পাতিল সুরক্ষা রাখে ওদের পাঠ্যপুস্তক ও পোশাক। খাল পার হয়ে ভেজা পোশাক পাল্টে ড্রেস পরে যেতে হয় স্কুলে।

জান্নাত, কেয়া, নাসরিন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ (দক্ষিণ অংশ) গ্রামের বাসিন্দা। চর থেকে এভাবে খাল সাঁতরে স্কুলে আসা-যাওয়া করে প্রায় অর্ধশত শিশু শিক্ষার্থী।

পাতিলে খাল পাড়ি দেওয়া ওদের নিত্যদিনের কাজ। তবু শঙ্কা থাকে দুর্ঘটনার। কখনো কখনো হাত থেকে ছুটে যায় পাতিল। ভিজে যায় বই, পোশাক। ঝুঁকি নিয়ে খাল পার হয় ওরা। খালটি পার হতে শিশুদের সময় লাগে দুই থেকে তিন মিনিট। শীতের সকালে এতেই ছোটে কাঁপুনি।

খাল সাঁতরে স্কুলে যাওয়া ওদের মধ্যে আট বছর বয়সী জান্নাতুল তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বাড়ি দিয়ারচর গ্রামে। পড়ালেখা করে মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এর মাঝখানে বয়ে যাওয়া বাইলাবুনিয়া নামক একটি খাল সাঁতরে স্কুলে যেতে হয় জান্নাতুলের।

জান্নাতুল বলে, ‘আমাদের আসতে অনেক ভয় হয়। দু-এক সময় হাত থেকে পাতিল ছুইট্টা (ছুটে) যায়। দুই-তিন দিন আগে হাত থেকে পাতিল ছুইট্টা গেছিল। আমরা অনেক কান্না করছি। কেউ ছিল না। পরে আমরাই আস্তে আস্তে কিনারে আসছি। বই-খাতা ভিজে গেছে। এখনো শুকায়নি। ’

স্থানীয় লোকজন জানায়, উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ (দক্ষিণ অংশ) গ্রামে কোনো স্কুল নেই। তাই পার্শ্ববর্তী মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে ওই দুই চরের শিশুরা। কিন্তু স্কুল এবং দুই চরের মাঝখানে বাইলাবুনিয়া খাল। এ খাল পেরিয়ে স্কুলে যেতে হয় শিশুদের। কেউ খাল সাঁতরে পার হয়। কেউ আবার পার হয় নৌকায়। কাঁচা হাতে নিজেই নৌকার বৈঠা বেয়ে খাল পার হওয়া দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ইউসুফ বলে, ‘যহন নৌকা পাই, তহন স্কুলে আই (আসি)। ’

স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকবার বাশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নোনা জলে সাঁকো বেশি দিন টেকে না। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে সাঁকো থাকাকালীন ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী ছিল। এর মধ্যে দুই শর মতো শিক্ষার্থী ছিল ওই দুই চরের। সাঁকো না থাকায় এখন শিক্ষার্থী কমে গেছে। এখন দুই চর থেকে ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী আসে। এদের কেউ কেউ নিয়মিত আসেও না।

শিক্ষার্থী অভিভাবক দিয়ারচর গ্রামের হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমার দুই ছেলে এই স্কুলে পড়ে। সপ্তাহখানেক আগে আমার এক ছেলে খাল পার হতে গিয়ে ডুবে যাওয়া ধরছে। আমি এসে উডাউয়া (উঠিয়ে) স্কুলে দিয়ে গেছি। আমার অনেক কষ্টে এই দুই ছেলে এখন স্কুলে আনা-নেওয়া করতে হয়। এর চেয়ে এখানে একটি স্কুল হলে ভালো হয়। আর তা না হলে এই খালে একটি ব্রিজ হলেও ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়তে দেওয়া যায়। ’

মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজের শিক্ষার্থীরা পাতিল নিয়ে খাল সাঁতরে এই বিদ্যালয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসে। অনেক অভিভাবকই এই ঝুঁকি নিয়ে ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে আসতে দেয় না। যদি স্কুলের পূর্ব পাশের এই খালে একটি ব্রিজ হতো, তাহলে শিশু শিক্ষার্থীরা এই ঝুঁকি থেকে রেহাই পেত। এই শীতের সময়ে শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট হয়। অনেকেই প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে স্কুলে আসে। অনেকে নিয়মিত স্কুলেও আসতে পারে না। ’

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্গম এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা একটি খাল পেরিয়ে আমাদের স্কুলে আসতে হয়। সেখানে একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য বেশ কিছুদিন আগে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছি। এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে বিকল্প কী করা যায়, এ জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আছে তাদের সঙ্গে আলাপ করে অতিদ্রুত বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করব। ’

এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী মিজানুল কবির বলেন, ‘আমরা সেখানকার খোঁজখবর নেব। প্রয়োজনে ব্রিজ নির্মাণের জন্য আয়রন ব্রিজ প্রকল্পে প্রস্তাবনা পাঠাব। ’

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা জেনেছি স্কুলে যেতে শিশু শিক্ষার্থীরা বই-খাতা এবং জামাকাপড় পাতিলে ভরে সাঁতার কেটে স্কুলে যায়। যেটা জেনে আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। আগামী দিনে কোমলমতি শিশুরা যাতে সুন্দরভাবে স্কুলে যেতে পারে সে জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব। কোমলমতি শিশুদের পারাপারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সালেক মূহিদ বলেন, ‘৭ ডিসেম্বর আমাদের মাসিক মিটিংয়ে এ বিষয়টি আমরা উত্থাপন করব। দ্রুত বিষয়টি সমাধানের জন্য রাজস্ব তহবিল অথবা পিআইও অফিসের প্রকল্পের মাধ্যমে ওখানে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ’

চখ/জুইম/সূত্রঃকালের কন্ঠ

এই বিভাগের আরও খবর