chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

চট্টগ্রামের শুঁটকি পল্লীতে দম ফেলার ফুরসত নেই

রসনা বিলাসিদের রসনায় শুঁটকি জনপ্রিয় খাবার। শীতে শুরু হয়েছে এ সুস্বাদু শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম। শুঁটকি পল্লীগুলোতে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম থেকে বছরে প্রায় ৪০ হাজার টন শুঁটকির চাহিদা রয়েছে। চট্টগ্রামের শুঁটকি দেশ ছাড়িয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

তবে শুঁটকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসকরা। তাদের দাবি, পোকা মাকড় থেকে রক্ষা এবং স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এসব শুঁটকিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক। যা স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর খুবই ক্ষতিকর।

কর্ণফুলী থানার ইছানগর এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ী আবু মোহাম্মদ জানান, অক্টোবরের শেষের দিক থেকেই ধীরে ধীরে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়। বর্ষাকালে টানা বৃষ্টির সময় ছাড়া বছরের ৭/৮ মাস শুঁটকি উৎপাদন চলে। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে। শত শত নারী-পুরুষও কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কর্ণফুলীর তীরে ও সাগরের বালিয়াড়িতে বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার উপর কাঁচা মাছ পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি। সূর্যের তাপে ৩/৪ দিনের মধ্যেই কাঁচা মাছ শুকিয়ে গিয়ে শুঁটকিতে পরিণত হয়।

বাকলিয়া বাস্তুহারা এলাকার আড়তের নারী শ্রমিক হিসাবে নিয়োজিত আছেন সাহেদা আকতার (২২)। তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, সাগর থেকে সংগ্রহ করা ছোট-বড় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছকে শুঁটকি করা হয়। শ্রমিকদের এখন যেন কারো এতটুকু দম ফেলার ফুরসত নেই।

আছাদগঞ্জ শুঁটকি আড়তদার সমিতির সভাপতি শফিউল আলম চট্টলার খবরকে জানান, চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গারচর, কর্ণফুলী ঘাট, ফিসারী ঘাট, চাক্তাই, রাজাখালী, মইজ্যারটেক, পতেঙ্গা, বন্দর, ইপিজেড,কর্ণফুলী থানার জুলধা, শিকলবাহ, চরলক্ষ্যা, ডাঙ্গারচর, লালদিয়ার চর, কক্সবাজারের নাজিরারটেক মহেশখালী, সোনাদীয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, বাশঁখালীসহ উপকূলীয় বিভিন্ন শুঁটকি আড়তে পুরোদমে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে।

তিনি জানান,চট্টগ্রামের আছাদগঞ্জে শুঁটকির ৪০টি আড়ত রয়েছে। ছোট-বড় দোকান রয়েছে ২৭০টির মতো। সেখানেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উৎপাদিত শুঁটকি বিক্রির জন্য চলে আসে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে চট্টগ্রামের এসব শুঁটকি আড়তে মাছের গুঁড়াসহ ৩০ থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। এছাড়া এখানকার শুঁটকি মাছের

গুড়া সারাদেশে পোল্ট্রি ফার্মও ফিস ফিডের জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে ৪০ থেকে ৪৫ প্রজাতির মাছকে শুঁটকি তৈরি হয়। এরমধ্যে রূপচাদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা, টেকচাঁদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, নাইল্যা, হাঙর, বাইল্যা, চাঁদা বাইল্যা, টিক্কা, ফ্লাইং, কোরাল ফিশ,কদমনী, বাটি, পোপা, চাপা, চামিলা, টেঁকচাঁদ, ইছা, ফেরকিগুলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুঁটকি উল্লেখযোগ্য। শুঁটকির মধ্যে সবচেয়ে দামি লাক্ষা ও রূপচাঁদা।

লালদিয়া চরের মাচাং মুন্সি মিয়া বলেন,  সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে এখানে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। কোনো রকম কীটনাশক ছাড়া শুধু লবণ পানিতে ধুয়ে রোদে শুঁকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। মাচাং-এ শুঁকাতে দিয়ে ৩ থেকে ৪ দিন রাখলে নদীর পাড়ের কড়া রোদেই এগুলো শুঁকিয়ে শুঁটকি হয়ে যায়।

শুঁটকি তৈরিতে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক কীটনাশক ব্যবহারের হয় জানিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, উদ্বেগের বিষয়, পোকা মাকড় থেকে রক্ষা এবং স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এসব শুঁটকিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক। যা স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর খুবই ক্ষতিকর।

চাক্তাইয়ের শুঁটকি ব্যবসায়ী সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ বলেন, চট্টগ্রামের  শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রফতানি করা হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, হংকং, চায়না ও তাইওয়ানের মতো দেশেও আমাদের দেশের শুঁটকির কদর রয়েছে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও এখন ইউরোপ ও আমেরিকাতেও অনলাইনে শুঁটকি বিক্রি করা হচ্ছে।

এ দিকে চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জসহ বিভিন্ন শুঁটকি বাজারে গতকাল পর্যন্ত প্রকার ভেদে প্রতি কেজি ছুরি ১০০০/১১০০ টাকা, লইট্যা ৫০০ টাকা, কোরাল ১৬০০/১৭০০ টাকা, লাক্ষা ৩৩০০/৫০০০ টাকা, রূপচাঁদা ৩৫০০/৩৭০০ টাকা, পোয়া ৭০০/৮০০ টাকা, তাইর্যা ২৪০০/২৫০০ টাকা, চৈইক্যা ৫০০/৬০০ টাকা, চাপিলা ৩০০/৪০০ টাকা, মলা ৫২০/৬৫০ টাকা, ফাসিয়া ৭০০/৮০০ টাকা, চিংড়ি ১৯০০/২০০০ টাকা, হাইচ চাদা ১৩০০/১৪০০ টাকা, ফাতরা বা সাদা পাতা ৯০০/১০০০ টাকা ও বড় ছোট হাঙ্গর শুঁটকি পাইকারি বিক্রি হয়েছে ৪০০/৮০০ টাকা করে বলে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামের উৎপাদিত শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দেশের মানুষের প্রোটিনের একটি বড় অংশ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উৎপাদিত শুঁটকি থেকে পূরণ হচ্ছে।

নচ/চখ

এই বিভাগের আরও খবর