chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

পটিয়ার পোনার বাজার “মিঁয়েইল্যা- মিঁয়েইল্যা” হাঁক ডাকে সরগরম

মাছের পোনা ও পানিতে একাকার চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বিস্তৃর্ণ অঞ্চল। মাছ চাষ ও রেণু উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য এসেছে পটিয়ার অনেকের। সেই সাথে মাছ চাষকে কেন্দ্র করে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রও গড়ে উঠেছে। কর্মসৃজন হয়েছে শত বেকারের। পটিয়ায় এখন যেখানে পানি সেখানে মাছ পাওয়া যাচ্ছে।

একসময় উপজেলায় অসংখ্য মজা পুকুর, খাল ও জলাশল ছিল। বর্তমানে সে দৃশ্যও পাল্টে গেছে। মাছের পোনাকে ঘিরে পটিয়া রেলওয়ে ষ্টেশন এলাকায় বসে কোটি টাকার পোনার বাজার। ষ্টেশন চত্বরেই পোনা বিক্রেতাদের হাঁক ডাকে রাতে শোর ওঠে “মিঁয়েইল্যা- মিঁয়েইল্যা”।

জানা যায়, উপজেলায় ৪ হাজার ১৯৯ একরের জলায়তনের মধ্যে পুকুরের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ হাজার। তারমধ্যে আবাদী সাড়ে ৯ হাজারটি। মাছের জন্য জলাশয় গুলোর পানি অতি উপযোগী হওয়ার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর মধ্যে হাইদগাঁও, কচুয়াই, কেলিশহর, খরণা, খানমোহনা, ধলঘাট, আশিয়া, জঙ্গলখাইন, হুলাইন, জিরি, মনশা, হাবিলাসদ্বীপ, ধলঘাট, গৌড়লা, কাশিয়াইশ, শিকলবাহা, শোভনদন্ডীসহ পটিয়া পৌর এলাকা এবং পশ্চিম পটিয়া কর্ণফুলী থানার অধিনে বেশ কয়েকটি এলাকার পুকুরগুলোতে পোনা চাষ করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। সেসব এলাকা থেকে পোনা সংগ্রহ করে পৌরসদরের রেলষ্টেশন বাজারে এনে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। বছরের জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত পোনার বিক্রির মৌসুম হওয়ায় রেলষ্টেশনের পোনার বাজারে এ চার মাস জমজমাট থাকে বলে পোনা ব্যবসায়ীরা জানায়। এছাড়া চার মাসের মৌসুম ছাড়াও সারা বছর এ বাজারের আশে পাশে গড়া উঠা পোনা বিক্রয় কেন্দ্রে পোনা ও চাষ উপযোগি মাছ বিক্রি হয়।

পোনা ব্যবাসায়ী ফজলুর রহমান জানায়, চট্টগ্রাম ছাড়াও কক্সবাজার, পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির এলাকার মাছ ও পোনা ব্যবসায়ীরা পটিয়ার রেল স্টেশন বাজার থেকে পোনা নিয়ে মাছ চাষ করে থাকেন। এছাড়া পটিয়ায় উৎপাদিত নানা প্রজাতির পোনা ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাত ১১টা থেকে রাত ৩ টা পর্যন্ত চলে পোনার বাজার। এসময় ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে উঠে রেলষ্টেশনের আশপাশের আধা কিলোমিটার এলাকায়। ক্রেতাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য পোনা বিক্রেতারা “মিঁয়েইল্যা- মিঁয়েইল্যা” (কয়েক ধরণের পোনার মিশ্রণকে স্থানীয় ভাষায় মিঁয়েইল্যা বলে), “দু’অঁইল্যা হাতাল- দু’অঁইল্যা হাতাল” অর্থাৎ দু আঙ্গুলের সমান কাতলা পোনা, বিক্রিতব্য পোনার ধরণের উপর বিভিন্ন ধরণের ডাক হাঁকে। প্রতিরাতে ১২০০-১৫০০ ভাড় (দুই কলসিতে একভাড়) পোনা বিক্রির জন্য এ বাজারে আসে পোনা ব্যবসায়ী বিক্রেতারা। অনেকে মাছ ও পোনা বেচা কেনা নিয়ে মধ্যাস্বত্বভোগী ও ফাঁড়িয়া ব্যবসা করছে। এই ব্যবসাকে উপজীব্য করে ৩০ হাজার মানুষ জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে।

পোনা বহন শ্রমিক আবুল কাশেম, মিনহাজ উদ্দিন ও জালাল আহমেদ বলেন, প্রতিদিন ৩৫০-৪০০টাকা আয় করেন তাঁরা।
রেলষ্টেশনের পোনার বাজার ছাড়াও পটিয়ায় একটি সরকারি মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র ও বেসরকারী মৎস্য পোনা উৎপাদনকারিগুলোর মধ্যে হযরত ওয়াশিল ফকির মৎস্য হ্যাচারী, মায়ের দোয়া মৎস্য খামার, ইউনাইটেড এ্যাকুয়া ফার্মস, জম জম ফার্মস, শাহ আমানত হ্যাচারী, তাহের শাহ মৎস আড়ৎ, হক এগ্রোভেট হ্যাচারীসহ আরো অনেক স্থানে পোনা বিক্রি হয়।
মৎস্য হেচারির মালিকরা জানায়, এ পেনার বাজারে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, পাঙ্গাশ, মাগুর, সিলভার কার্প, থাই মাগুর, সরপুঁটি, বিগহেড, গ্লাস কার্প, শিং, চিতলসহ আরো অনেক মাছের পোনা বিক্রি হয়।
সাতকানিয়া থেকে আসা শাহেদ মুন্সি নামের এক ক্রেতা জানায়, ‘আষাঢ়-শ্রাবণ পুকুরে পোনা ছাড়ার মোক্ষম সময়। পোনা ভালো জাতের হলে পুকুরে মাছ যেমন বাড়বে, তেমনি স্বাস্থ্যবান হবে। পটিয়ায় ভালো জাতের পোনা জন্মে। তাই প্রতি মৌসুম এখান থেকেই পছন্দের পোনা সংগ্রহ করি।
তিনি বলেন, গত বছর এক একরের একটি পুকুরে দশ হাজার টাকার পোনা ছেড়ে দেড় লাখ টাকা আয় করেছি।

পোনা ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, ভার করে বিক্রি করা হয় রুই, কাতলা, সরপুটি, মৃগেল, গ্লাস কাপ আর ইঞ্চি হিসেবে বিক্রি করে পাঙ্গাস, মাগুর, কই, চিতল, দেশি মাগুর, শিং মাছের পোনা। আর এ বাজারে প্রতিদিন সাতশ’ থেকে এক হাজার ভার মাছের পোনা বিক্রি হয়। রুই, কাতলা, মৃগেল-এ তিন প্রকার পোনা একসঙ্গে বিক্রি করা হয় বলে এর নাম ‘মিঁয়েইল্যা’। দুটি ডেক্সি নিয়ে হয় এক ভার। এক টেক্সিতে চার-ছয় কেজি, আর এক ভারে হয় আট থেকে দশ কেজি পরিমাণ পোনা। প্রতি ভার ৭/৮ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। এছাড়া ইঞ্চি হিসাবে বিশেষ করে চিতল মাছের পোনা একশটির মূল্য সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এভাবেই বিক্রি হয় এখানের পোনা গুলো। সব মিলিয়ে প্রতিদিন এ বাজারে প্রায় ১০/১৫ লাখ টাকার পোনা কেনা বেচা হয়।

এক হিসাবে দেখা দেখে প্রতিবছরে মওসুমের সময় চার মাসে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ হিসাব করে প্রায় ১২ কোটি টাকার অধিক পোনার বাণিজ্য হয় এ বাজারে।

কামাল বাজারের মায়ের দোয়া মৎস্য খামারের মালিক মো. সোহেল বলেন, প্রতিদিন এ বাজার রাত ১১টার পর শুরু হয়ে শেষ রাত পর্যন্ত চলে। বছরের জুন থেকে অক্টোবর এ চার মাস এ বাজার জমজমাট পোনা কেনা বেচা হয়। এছাড়া বছরের অন্যান্য দিনে পুকুরে নেটের মাধ্যমে পোনা বিক্রি করে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আমার ২০টির অধিক পুকুরে পোনা চাষ করি। এসব পুকুর থেকে পোনা সংগ্রহ করে রেলষ্টেশনের পোনার বাজারে বিক্রি করি।
তিনি বলেন, এখানে অনেকে পোনা চাষ ও বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছে। তিনি এ সম্ভাবনাময় খাতকে ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে ঋণদানের ব্যবস্থা করে দেয়ারও আহবান জানান।

এই বিভাগের আরও খবর