chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

মাহি হিজড়ার সেলাইকরা দু:খ-গাঁথা

সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ,বিশেষ প্রতিনিধিঃ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের প্রবেশ পথ শাহ আমানত সেতু এলাকা। তার একটু পশ্চিমে কয়েক শ’ গজ গেলে ভেড়া মার্কেট। কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা শ্রমিক কলোনীর ঝুঁপড়িতে বসে লবন-মরিচ দিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন ১৯ বছর বয়সী মাহি হিজড়া। অপরিচিত লোক দেখে তিনি তা লুকানোর চেস্টা করেন। যেন কোন অপরাধ করেছিলেন তিনি। যখন পাশে গিয়ে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর তিনি কেঁদে ফেললেন অঝোর ধারায়। তিনি বলেন, ‘ভাই আমাকে বাঁচান,মনে হয় না খেয়ে মরব।’

মাসে দুই হাজার টাকায় ভেড়া কলোনীর ঝুঁপড়ি একটি ঘরে বসবাস করছে মাহি। আমবশ্যায় কর্ণফুলী নদীর পানি বাসায় ঢুকে টয়টম্বুর হয়। অন্ধকার ঝুঁপড়ি ঘরটিতে কয়েকটি রঙ্গিন জামা-কাপড় ছাড়া নেই বলতে কিছুই নেই। ১০ বছর বয়সে সম্ভ্রান্ত পরিবারে বেড়ে উঠা মাহিকে মমতাময়ী মা-বাবা ও স্নেহময়ী ভাই-বোন সমাজের নিষ্ঠুরতার কাছে হার মেনে দূরে ঠেলে দেয়। কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার মইজ্জ্যার টেক এলাকায় তার সমলিঙ্গদের (হিজড়া) সাথে জায়গা হয়। এসব কথা বলতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হন মাহি। তাঁর জীবনের দু:খ-গাথার কথা শুনালেন এ প্রতিবেদককে।

মাহির পরিবর্তন :

কুমিল্লার মুরাদনগর এলাকার মুহাম্মদ ইউসূফের ৬ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সন্তান মাহি। ছেলে হয়ে জন্ম নেয়া মাহি শার্ট প্যান্ট পড়ে স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে। ছেলে হিসেবে জন্ম নিলেও ছোট বেলা থেকেই মেয়েদের কাপড় পরতে ভাল লাগতো,মেয়েদের সাথে মিশতে ভাল লাগত। এজন্য তাঁর ভাই,বাবা মায়ের কাছ থেকে তাঁকে অনেক মারধর খেতে হয়েছে। তার বয়স যখন সাত বা আট বছর, তখন থেকেই তার হাটা-চলা মেয়েদের মত থাকে। যত বয়স বাড়তে থাকে সে উপলদ্ধি করে সে অন্যদের থেকে আলাদা। তখন সে বিষন্নতায় ভুগতো আর ভাবতো তাঁর মত আর কেউ নেই। মাহি বলছিলেন এর এক পর্যায়ে তিনি ১০ বছর বয়সে পরিবার ছেড়ে যোগ দেন অন্যান্য হিজড়াদের সাথে।

বাঁধন ছাড়া :

২০০৮ সালের এক সকালে পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার পর মাত্র ১০ টাকা নিয়ে কুমিল্লা থেকে ট্রেনে করে চট্টগ্রামে ষোলশহর রেল ষ্টেশনে পৌছে সে। সেখানে দেখা হয় তার মত স্বভাবের কয়েকজনের সঙ্গে। তারা তাঁকে নিয়ে যায় কর্ণফুলী থানার মজ্জ্যারটেক এলাকায়। সেখানে ৯জন হিজড়ার সঙ্গে তাঁর শুরু হয় জীবনের আরেকটি অধ্যায়। ছল্লা (ভিক্ষা) করে, নেচে-গেয়ে প্রতিদিন যা পাওয়া যায় তার অর্ধেক নিয়ে যায় গুরু মা, বাকি টাকা দিয়ে চলে নিজের জীবন। মাহি জানান, নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর পরিবারের কেউ খবর রাখেনি। গত ৯ বছরে তাঁর তিন ভাই মুহাম্মদ রনি, মুহাম্মদ রুবেল ও ফারহাদের বিয়ে হয়। বিয়েতে পাননি দাওয়াতও। ছোট বোন মাহিন প্রায় সময় ফোন করে মা’র সাথে যোগাযোগ করে দিলেও নানা কারণে পরিবার নিয়ে থাকার স্বপ্ন সম্ভব হচ্ছেনা। বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেলেও পাষ- বড় ভাইয়েরা তাকে বাড়িতে না আসতে নির্যাতন চালায়। মহি বলেন,আমরা হিজড়ারা পরিবার-পরিজনের কাছে ডাস্টবিনের ময়লার মতো। তিনি বলেন, আমাদের ভোটাধিকার নেই। সম্পত্তির কোন অধিকার নেই, কোথাও গ্রহনযোগ্যতা নেই। সমাজ আমাদের মেনে নেয় না। আমার জন্য ভাই-বোনেরাও সমাজে মুখ দেখাতে পারে নাই।

মাহির ইচ্ছে ও কষ্টঃ

মাহি তার ইচ্ছেগুলো অধরা প্রসঙ্গ টেনে বলেন,‘ছোট বেলা থেকে খুব ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা শেষ করে পুলিশের চাকরি নিব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বো। কিন্তু স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের অসহযোগিতার কারণে পঞ্চম শ্রেণীতে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। তারপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। এভাবে তাঁর পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে। তিনি বলেন,আমাদের বাসা ভাড়া কেউ দিতে চায়না। গণপরিবহনে যাত্রীরা আমাদের পাশ থেকে উঠে যায়। খাবার দোকানে ঢুকলে অন্য ক্রেতারা বের হয়ে যায়। পথ চলতে ব্যঙ্গবিদ্রুপের শিকার হই। নানাভাবে আমরা অবহেলা ও বয়কটের পাত্র হই। যেন আমরা মানুষ না, ভিন গ্রহের অলক্ষী প্রাণী।
মাহি বলেন,‘আমার ইচ্ছা করে মা, বাবা ও পরিবারের সাথে থাকতে। আমার মা-বাবা আমাকে রাখতে চায়, কিন্তু বিবাহিত ভাই এবং সমাজের মানুষের কথার ভয়ে তারা আমাকে তাদের কাছে রাখে না। তিনি বলেন, আমার মনে খুব কষ্ট। মাঝে মধ্যে মনে হয় আত্মহত্যা করি। তিনি বলছিলেন,১০ বছর বয়সে তাঁর মা-বাবা তাঁকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে হিজড়াদের কাছে ঠেলে দেয়।
মাহির মা সুফিয়া বেগমের (৬০) সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘যে গর্ভে সন্তান ধারণ করে, তিনিই বুঝেন সন্তান দূরে থাকার কি যন্ত্রাণা। আমাদের সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনৈতিক প্রভাবের কারণে নিজের সন্তানকে নিজেদের কাছে রাখতে পারছিনা।

পর্যবেক্ষণ :

শুধু মাহি নন, এ করুন কাহিনীর বাস্তবতা হিজড়া জনগোষ্ঠীর। শুধু রাস্তায় অনেক সময় অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা নয়, এই হিজড়া জনগোষ্ঠী তাদের পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন। সমাজে লোকলজ্জার কারণে পরিবারগুলোও তাদের হিজড়া সন্তানকে ঠেলে দেয় রাস্তার অনিশ্চিত ভাবষ্যতের দিকে। রাস্তাঘাটে হাত পেতে কিংবা বিভিন্ন দোকানে গিয়ে দু’এক টাকা আদায় করেই হিজড়াদের জীবন চলে। পরিবার কিংবা সমাজ কোথাও তাদের ঠাই নেই। তৃতীয় লিঙ্গ স্বীকৃতি পেলেও হিজড়া জনগোষ্ঠিকে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এখনো বেশিভাগ মানুষই তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। তাদেরকে নানাভাবে হেয় করেন। বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে অফিস-আদালত কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোন জায়গাতেই তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয় না এবং তাদের প্রবেশাধিকারও সীমিত। হিজড়া বলে মানুষ তাদের খারাপ চোখে দেখেন এবং ‘অস্পৃশ্য’ কিছু মনে করেন।