বঙ্গোপসাগরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ১৮ জলদস্যু বাহিনী
টোকেন নিয়েই ধরতে হয় মাছ
সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ, বিশেষ প্রতিনিধি : জলদস্যুদের ১৮ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে বঙ্গোপসাগর। প্রায় ৫ লাখের বেশি জেলে এবং ৩০ হাজার ফিশিং ট্রলারের মালিক এসব বাহিনীর কাছে জিম্মি। চলতি বছরের কমপক্ষে শতাধিক জেলেসহ ১৫টি ফিশিং বোট অপহরণ করেছে এসব বাহিনী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার, কুতুবদিয়াসহ চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং খুলনায় জলদস্যু বাহিনীগুলোর এ দাপট সবচেয়ে বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে জলদস্যুরা দাপটের সাথে সাগর সীমানায় রাজত্ব করলেও কার্যকরী কোন উদ্যোগ নিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। তবে কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, লোকবল সংকটের কথা।
চট্টগ্রাম নগরীর ফিশারী ঘাটস্থ বোট মালিক ও মাঝি মাল্লারা জানান, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে জলদস্যুদের কাছ থেকে মাঝি-মাল্লাদের চাঁদার টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিটা টোকেনের জন্য জলদস্যুদের দিতে হয় ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এসব টোকেনের মেয়াদ থাকে ছয় মাস।
জলদস্যুদের দেওয়া এসব টোকেনে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর নাম ও গায়ে সিল মারা থাকে। কোন বাহিনীর হাতে ট্রলার অপহৃত হওয়ার পর এসব টোকেন দেখালেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
যাদের কাছে জলদস্যুদের এ বিশেষ টোকেন থাকে না তাদের ইঞ্জিন, জাল, মাছসহ লুট করে নিয়ে যায়। কেউ যদি এসব কাজে বাঁধা দেয় তখন তাদের হত্যা করা হয়। আবার অনেক মাঝি-মাল্লাকে হত্যা না করে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে মুক্তিপণের মাধ্যমে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে বলা হয়।
বোট মালিকদের পরিবার আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার দেনা করে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জলদস্যুদের চাঁদার দাবি পূরণ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে সক্রিয় জলদস্যু বাহিনীর মধ্যে রয়েছে বাঁশখালী গন্ডামারার রবি বাহিনী, ইয়াছিন বাহিনী, আমিন বাহিনী, জাফর বাহিনী, ছনুয়ার বাইশ্যা বাহিনী, জব্বর বাহিনী, কুতুবদিয়ার বইঙ্গ্যা বাহিনী, রমিজ বাহিনী, মহেশখালীর ছবুর বাহিনী, সুন্দরবন এলাকার রাজু বাহিনী, মোতালেব বাহিনী, হাতিয়ার মুন্সিয়া বাহিনী, আব্বাস বাহিনী, মিস্ টিয়া বাহিনী, জুলফিকার বাহিনী, মতলব বাহিনী, গিয়াস বাহিনী ও কৃষ্ণ সাগর বাহিনীর হাতে অন্যতম। তারা কুতুবদিয়া চ্যানেল, সুন্দরবন, হাতিয়া, মংলা, মহিষাসুরসহ অসংখ্য এলাকায় ফিশিং ট্রলার অপহরণে জড়িত।
দীর্ঘ দিন ধরে জলদস্যু গ্রেফতারে কোস্টগার্ড ও র্যাব কাজ করছে। ফলে সাগরে জলদস্যুতা অনেকটা কমে এসেছিল। বেশ কিছু জলদস্যু র্যাবের হাতে আটক হয়ে জেলে রয়েছে।
কিছু জলদস্যু র্যাবের হাতে আত্মসমার্পণ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। সম্প্রতি নানা কারণে গ্রেফতার এড়িয়ে চলা দস্যুরা বঙ্গোপসাগরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
২৬ আগস্ট দিবাগত রাতে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া থেকে কালীচর পর্যন্ত প্রায় ৫০ নটিক্যাল মাইল এলাকায় গণলুটের ঘটনা ঘটে। ৯টি মাছ ধরার বোট থেকে প্রায় কোটি টাকার ইলিশ লুট হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন জেলেরা।
পুলিশ জানায়, একটি গ্রুপ একাধিক টিমে ভাগ হয়ে একই সময়ে দস্যুতার ঘটনা ঘটায়। ডাকাতির সময় দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ট্রলারে থাকা জেলেদের ইঞ্জিন রুমে বেঁধে ইলিশ মাছ লুট করে নিয়ে যায় জলদস্যুরা।
নৌ পুলিশের চট্টগ্রামের সদরঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এবিএম মিজানুর রহমান ঘটনার পর গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ডাকাতির ঘটনাগুলো ঘটেছে কক্সবাজারের মহেশখালী, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা ও সন্দ্বীপ থানা এলাকায়।
একাধিক বোট মালিকরা জানান, মাছ ধরার মৌসুম শুরু হলেই বাড়ে জলদস্যুদের তৎপরতা। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি নোয়াখালীর ১৭ জন জেলে মাছ ধরার জন্য সাগরে গিয়ে জলদস্যু কবির বাহিনীর কবলে পড়েন।
নৌকাটিতে ১৭ জন জেলে ছিলেন। কবির বাহিনীর ১৫ দস্যু মাছ ধরার বোটসহ তাদের অপহরণ করে। এরপর জেলেদের জিম্মি করে মারধর ও নির্যাতন চালায় তারা।
এসময় বোট মালিকের কাছে জলদস্যুরা ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরবর্তীতে বোটের মালিক জলদস্যুদের ২ লাখ টাকা প্রদান করেন। এছাড়া জেলেদের ২ হাজার পিস ইলিশ মাছও তারা লুট করে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় র্যাব-৭ ২১ জানুয়ারি কক্সবাজারের উপকূলীয় উপজেলা পেকুয়া, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে জলদস্যু কবীর বাহিনীর প্রধান নূরুল কবীর ও সেকেন্ড ইন কমান্ড মামুন ও তাদের ১৩ সহযোগীকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
কোস্টগার্ড ও র্যাবের যৌথ অভিযানে ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম-হাতিয়া চ্যানেলে জেলেদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের হোতা জলদস্যু নেতা কামালসহ পাঁচ জলদস্যুকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র।
১৮ জুলাই কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী সমুদ্র উপকূল এলাকা থেকে তিনটি ওয়ান শুটারগানসহ জলদস্যু মো. হানিফকে গ্রেফতার করে র্যাব।
বিভিন্ন সময় জলদস্যু ধরা পড়লেও অধিকাংশ জলদস্যু ধরা না পড়ার কারণ হিসেবে প্রশাসনের লোকজনদের বক্তব্য হচ্ছে, এই জলদস্যুদের আধুনিক নৌযান এবং আগ্নেয়াস্ত্র আছে। ফলে দস্যুতা করে খুব দ্রুত তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাই সাগরে থাকলে তারা খুব কম সংখ্যক ধরা পড়ে।
চখ/আর এস