chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

চিনির বাজারে অস্থিরতা শতক ছুইছুই

নিউজ ডেস্কঃ সবচেয়ে বেশি চিনি উৎপাদনকারী দেশগুলোতে খরার কারণে উৎপাদন কমে যাওয়া, বিভিন্ন দেশ নিজস্ব পণ্য রফতানি সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয়াসহ বিভিন্ন কারণে চিনির বাজারও অস্থির হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এর প্রভাবে বেড়ে গিয়েছে অপরিশোধিত চিনির বুকিং দর। যার রেশ পড়েছে বাংলাদেশের বাজারেও। এক মাসের ব্যবধানে দেশে পাইকারি পর্যায়ে চিনির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৬-৭ টাকা, খুচরায় যা আরো বেশি।

চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গিয়েছে, সাধারণত দেশে প্রতি বছর ২০-২২ লাখ টন চিনি আমদানি করা হয়। তবে সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে মাত্র ১৭ লাখ টন। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চিনি আমদানি হয়েছিল ২১ লাখ টন। এক বছরের ব্যবধানে ৪ লাখ টন চিনি কম আমদানি হওয়ায় সরবরাহ সংকটে পড়েছে দেশের প্রধান বেসরকারি রিফাইনারি মিলগুলো। পাশাপাশি দামও বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই মাস আগেও পাইকারি পর্যায়ে চিনির মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) দাম ছিল ২ হাজার ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৭৫০ টাকা। দাম বাড়তে বাড়তে পণ্যটির মণপ্রতি দাম ৩ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ গতকাল দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে মণপ্রতি চিনির দাম এসও (সরবরাহ আদেশ) পর্যায়ে ৩ হাজার ৫০ টাকা এবং পাইকারি পর্যায়ে ৩ হাজার ৮০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। গত এক মাসের ব্যবধানে বাজারে চিনির দাম বেড়েছে মণপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা। চাহিদামতো সরবরাহ কম থাকায় পণ্যটির দাম আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এক বছর আগে সরকারি পর্যায়ে চিনির কেজিপ্রতি দাম ছিল ৬৫ টাকা। পরে এক দফায় দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে ৭০ টাকা করা হয়। এরপর ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) চিনির দাম আরো ৫ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে। সবশেষ ১০ আগস্ট বেসরকারি মিল মালিকদের অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে চিনির দাম পুনর্নির্ধারণের আবেদন করে। মূলত বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রত্যাহার করা শুল্ক সুবিধা উঠে যাওয়ায় দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মিল মালিকরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেয়া চিঠিতে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে চিনির দাম বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। এছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের দামে ডলার পেতে আবেদন করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি চিনি ৭০ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে ওঠানামা করলেও বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে চিনি প্রতি কেজি ৯০ থেকে ৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে চিনির চাহিদা বেশি থাকায় সরবরাহ সংকটের কারণে দাম প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে।

বাংলাদেশ চিনি ডিলার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে চিনি আমদানিতে শুল্ক অনেক বেশি। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হওয়ায় দাম বেড়ে গেলে সরকার শুল্ক কিছুটা কমিয়ে দেয়। বর্তমানে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় পাইকারি বাজারেও দাম বেড়ে গিয়েছে। এ অবস্থায় চলতি মৌসুমে সরকারি সব মিলে উৎপাদন চালু করার পাশাপাশি চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি পর্যায়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশে দুই ধরনের চিনি আমদানি হয়। এগুলো হলো অপরিশোধিত চিনি ও পরিশোধিত বা সাদা চিনি। অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ট্যারিফ ভ্যালু ধরা হয় টনপ্রতি ৩৫০ ডলার। আমদানি পর্যায়ে এ চিনিতে ৩ হাজার টাকা স্পেসিফিক ডিউটি বা কাস্টমস ডিউটি দিতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর এবং ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর।

অন্যদিকে সাদা চিনির ক্ষেত্রে টনপ্রতি ৪৩০ ডলার ট্যারিফ ভ্যালু ধরে ৬ হাজার টাকা কাস্টমস ডিউটি ছাড়া বাদবাকি শুল্ক অপরিশোধিত চিনির মতোই। তবে চলতি বছরের শুরুতে চিনির দাম বেড়ে গেলে সরকার অপরিশোধিত আমদানির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে। এরপর একই সুবিধা চলতি বছরের ১৫ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ছাড়াও ১০ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহালের কারণে চিনির দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা প্রায় ১৮-২০ লাখ টন। দেশীয় চাহিদার মধ্যে সরকারি মিলগুলো একসময় দেড়-দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করত। তবে সর্বশেষ দুই বছরে ১৫টি সরকারি চিনিকলের মধ্যে ছয়টির উৎপাদন বন্ধ থাকায় উৎপাদন যথাক্রমে ৪৮ ও ২৫ হাজার টনে নেমে এসেছে। যার কারণে দেশের চিনি খাতটি প্রায় শতভাগ বেসরকারি মিলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বিশ্বব্যাপী চিনির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কিছুটা সংকটে রয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ১০ শতাংশ মওকুফ করা শুল্ক পুনর্বহাল হওয়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। যার কারণে চিনির বাজারমূল্য ধারাবাহিক বেড়ে গিয়েছে। তবে চিনি অতি নিত্যপণ্য না হওয়ায় ভোজ্যতেল, গমের মতো অস্থিরতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

যদিও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিনি ভোজ্যতেল কিংবা গমের মতো অতি নিত্যপণ্য না হলেও খাদ্যাভ্যাসের কারণে পণ্যটির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এক দশক আগেও দেশে চিনির চাহিদা ১৫ লাখ টন ছিল। বর্তমানে চিনির চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন ছাড়িয়ে গিয়েছে। খাদ্যাভ্যাসজনিত পরিবর্তনের কারণে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্য উৎপাদনে চিনির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দেশে চিনির সরবরাহ সংকট বাজারকে অস্থিরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অপরিশোধিত চিনির কেজিপ্রতি দাম ছিল ৫৮ সেন্ট। ২০২০ সালে দাম ছিল ৫৯ সেন্ট। কিন্তু ২০২১ সালে চিনির কেজিপ্রতি দাম বেড়ে ৭৪ সেন্টে উঠে যায়। সর্বশেষ চলতি বছরের মে মাসে কেজিপ্রতি চিনির দাম সর্বোচ্চ ৮০ সেন্ট উঠে গেলেও জুনে ১ সেন্ট কমে ৭৯ সেন্টে নেমে আসে। জুলাইয়ে কেজিপ্রতি চিনির গড় দাম ছিল ৭৭ সেন্ট।

বিশ্বের প্রধান চিনি উৎপাদক ও রফতানিকারক দেশ ব্রাজিল। সম্প্রতি দেশটির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গিয়েছে। যার কারণে রফতানিতে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করেছে দেশটি। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের কারণে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি উৎপাদন প্রবণতায় পাম অয়েলের পাশাপাশি চিনির ওপরও প্রভাব পড়েছে। ব্রাজিল আখ থেকে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি ইথানল দিয়ে বায়োডিজেল উৎপাদন করায় বিশ্বব্যাপী চিনির দাম বাড়ছে।

চখ/জুইম

এই বিভাগের আরও খবর