chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

বেদনার্ত হৃদয়ে লেখা স্মৃতিকথা

আগস্ট বাঙালি জাতীয় জীবনে অত্যন্ত বেদনা বিধুর, অশ্রু ঝরানো, শোকাবহ মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতি হারিয়েছে তার অমূল্য রতন। বাংলার জনপদে নিরলস ছুটে চলায় যিনি বাঙালি জাতিসত্তাকে মুক্তির মোহনায় উপনীত করেছিলেন, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু বাঙালির অধিকার আদায়ের কথা বলতে গিয়ে কারান্তরীন হয়ে কাটিয়েছিলেন, যার তর্জনী হেলনে নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামী ও গেরিলা যোদ্ধা হয়ে ওঠেছিল, এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। সেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালির কপালে কালিমা লেপন করে স্বার্থলোভী ও চাকুরিচ্যুত কতিপয় সেনা কর্মকর্তা। তাদের পিছনে কলকাঠি নেড়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু দেশী, বিদেশী কুচক্রী মহল।

১৯৭৫ সালের আগস্ট মাস। সেদিনের কিছু স্মৃতিকথা আজ আমি নতুন প্রজন্মের জন্য এখানে তুলে ধরতে চাই। ‘বাংলাদেশ জাতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ এর ব্যানারে চট্টগ্রামে আমরা একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম। স্থানীয় মুসলিম হলে ১৭ আগস্ট হতে ১৯ আগস্ট তিনদিনব্যাপী এ সম্মেলন হবে ঠিক হল। তপন বৈদ্য ছিলেন এ সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক আর আমি ছিলাম যুগ্ম আহ্বায়ক। ভারত ও বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের অনেকেরই এ সম্মেলনে উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনি ভাই এ ব্যাপারে আমাদেরকে বিশেষ সহযোগিতা করেছিলেন। কথা ছিল, সম্মেলনের প্রত্যেকদিন একটি করে তিনদিনে মোট তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করা হবে। আর, নাটক পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। জাতীয় সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার উন্নয়নে জাতির জনকের জ্যেষ্ট পুত্র শেখ কামাল ছিলেন অন্তপ্রাণ। আমাদের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবে আমরা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব শেখ কামাল সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় আমরা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ মান্নান ভাইয়ের বাসায় যাই, তার সাথে আমাদের সম্মেলন প্রস্তুতির নানাদিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।

তিনি আমাদেরকে সম্মেলনের খরচের জন্য ৫০০০ টাকা দেন এবং রাতের ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এরপর আমরা তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ.বি. চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাদেরকে পরদিন সকালে তার বাসায় যেতে বলেন। সর্বশেষে আমরা তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকার চট্টগ্রাম প্রতিনিধি নুরুল ইসলাম সাহেবের বাসায় যাই। কাশেম চিশ্‌তী সাহেবও সেদিন আমাদের সাথে ছিলেন। নুরুল ইসলাম সাহেবের বাসার ল্যান্ড ফোন থেকে আমরা সম্মেলনের উদ্বোধক বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি ১৭ তারিখে আমাদের সম্মেলনে যথাসময়ে উপস্থিত থেকে উদ্বোধন করার ব্যাপারে আমাদেরকে শতভাগ আশ্বাস প্রদান করেন। নুরুল ইসলাম সাহেবের নন্দনকানস্থ বাসা থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে পৌঁছাই যখন, তখন রাত ১টা। বেশকিছু কুকুর একসাথে কান্নার রোল তুলে ডাকছিল। মনটা কেমন যেন মোচর দিয়ে উঠল, কেমন যেন বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল শরীর মন। তাছাড়া মুরব্বীদের মুখে শুনেছি, কুকুরের কান্না নাকি অশুভ লক্ষণ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তপন বৈদ্য বলল দেশে কোথায় কোন অঘটন ঘটতে চলেছে কে জানে? কুকুরগুলো এভাবে কান্না করছে কেন? আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ওসব কিছুই না। এগুলো সব মুরব্বীদের বলা কুসংস্কার। তারপর আমরা ঘুমোতে যাই। সকালে ওঠে ডিসি সাহেবের বাসায় যাব এমন সময় লেয়াকত নামের জাসদ সমর্থক এক ছাত্র আমাকে জানাল বঙ্গবন্ধুকে নাকি ভোর বেলায় হত্যা করা হয়েছে। আরেকটু পর আরেক ছাত্রনেতা গোলাম মোহাম্মদও একই কথা বলল। আমি তাদের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্যারেড কর্ণারের পূর্বপাশে খালেকের বাসায় গিয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠালাম। বললাম, তোমাদের রেডিওটা অন কর। রেডিও অন করতেই খুনিদের ঘোষণা শুনতে পেলাম। তবুও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, এসব কিছু স্বাধীনতা বিরোধীদের অপপ্রচার।

আমরা দ্রুত মতিন বিল্ডিং এর ছাত্রলীগের অফিসে গেলাম। সেখানে ছাত্রলীগ নেতা সরফরাজ খান বাবুল, সন্দ্বীপের রফিকুল ইসলাম, ফটিকছড়ির আনোয়ারুল আজিম, শওকত হোসেন, মান্নান, ইসমাইল, কাশেম চিশ্‌তী, পটিয়ার এম এ জাফর, শামসুজ্জামানসহ বিশ পঁচিশজন ছাত্রনেতাকে একসাথে পেলাম। তৎক্ষণাত বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কে.সি দে রোড, টি এন্ড টি অফিস, লালদীঘি হয়ে রেয়াজ উদ্দীন বাজার আমতল, তিনপুলের মাথা হতে ঘুরে শহীদ মিনার হয়ে পুনারায় পার্টি অফিসে আসি। কোথাও কোন বাঁধা পাইনি। রাস্তায় তেমন কোনো মানুষজন কিংবা পুলিশও ছিল না। সবদিকে কেমন জানি শুনশান নিরবতা। তপন বৈদ্যর বাসা ছিল ফকিরহাট। মিছিলের পর আমরা তার বাসায় যাওয়ার পথে আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশনের সামনে নামলাম এবং স্টেশনে ঢুকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বক্তব্য রাখার সুযোগ চাইলাম। রেডিও কর্তৃপক্ষ রাজী হলেন না। তারপর তপন বৈদ্যর বাসায় চলে যাই। বাকশাল সাধারণ সম্পাদকের সাথে জেলা গর্ভণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্য নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলেই ঢাকায় ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ঢাকার সাথে সারা দেশের সমস্ত যোগাযোগ মূলত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিকেলে আমরা আবারো বেরিয়ে পড়ি। মুক্তিযোদ্ধা চেঙ্গিস খানের শ্বশুরের কাজীর দেউড়িস্থ বাড়ীর সামনের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা কয়জন কথা বলছিলাম। বিকেল পাঁচটার দিকে দেখলাম সামরিক বাহিনীর কিছু গাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে পথচারীদের হুমকি, ধমকি দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। আমরা রাস্তার পাশ ছেড়ে কিছুটা ভেতরে গলির দিকে ঢুকে পড়লাম। আমাদের মধ্যে কাশেম চিশ্‌তীর বাসা ছিল চাক্তাই। আমরা সবাই যে যার বাসায় চলে গেলাম।

১৭ আগস্ট সকালে চট্টগ্রাম কলেজ হোস্টেল থেকে রাউজানের সালাম ও বাবুল আমাদের বহরদার বাড়ির বাসায় আসে পরবর্তী করনীয় বিষয়ে আলোচনা করতে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মী ও কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথেও যোগাযোগ করতে লাগলাম।

লেখক : মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন

এই বিভাগের আরও খবর