chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

বাবা অ্যাঁরারে বাঁচাও, মনেঅ্যয় না খাই মইরগুম

সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ,বিশেষ প্রতিনিধিঃ শ্রমিক কলোনীর ঝুপড়িতে বসে লবণ-মরিচ দিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন ত্রপা রাণী-(৬৬)। অপরিচিত লোক দেখে তিনি তা লুকাতে চেষ্টা করেন। যেন কোন অপরাধ করেছিলেন তিনি। যখন তাঁর পাশে গিয়ে নিজেকে গণমাধ্যম কর্মী পরিচয় দেয়ার পর তিনি কেঁদে ফেললেন অঝুর ধারায়।তিন বলেন বাবা অ্যাঁরারে বাঁচাও, মনেঅ্যয় না খাই মইরগুম”।

চন্দনাইশের লট এলাহাবাদ এলাকার ‘পটিয়া টি ষ্ট্রেট’ এ গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা হয়। এক সময় পটিয়া টি ষ্ট্রেটে ত্রপা রাণী চা শ্রমিক ছিল। এখন তার কিছুই নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু ত্রপা রাণী নন,ঠিক মত বেতন মজুরি না পেয়ে এবং বন্ধ হয়ে পড়া চা বাগানগুলোর অধিকাংশ শ্রমিক পরিবার দিন কাটাচ্ছে অর্ধাহারে-অনাহারে। পটিয়া টি ষ্ট্রেট বন্ধ হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা ফটিকছড়ির বেশ কয়েকটি চা বাগানের। এসব চা বাগানের শ্রমিকের একটি অংশ ভিন্ন পেশায় গিয়ে জীবিকা চালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এতেও তেমন কোন সুবিধা হচ্ছেনা।

ফটিকছড়ির চা শ্রমিক রীতা দাশ জানালেন, তার দৈনিক মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। নেই থাকা খাওয়া, ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা ও চিকিৎসার নূন্যতম সুযোগ-সুবিধা। বংশ-পরম্পরায় অস্বাস্থ্যকর গিঞ্জি পরিবেশে দিন কাটে তাদের। এরা যুগ যুগ ধরে অবহেলিত শোষিত ও বঞ্চিত।

 

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ১৭টি চা বাগান ঘুরে চা শ্রমিকদের সাথে আলাপকালে তাদের জীবনের করুণ কাহিনী ফুটে ওঠে।জানা যায়, ফটিকছড়ির ১৭টি চা বাগানে হাজার হাজার শ্রমিক বংশানুক্রমিকভাবে কাজ করে আসছে। এদের অধিকাংশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হতে এসে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এদেশে চা শ্রমিকের কাজ করে আসছে। চা শ্রমিকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরলেও কেউ তাদের নাম প্রকাশে রাজি হয়নি। তারা জানায়, চা বাগানে স্থায়ী ও অস্থায়ী দু ধরনের শ্রমিক রয়েছে। স্থায়ী শ্রমিকেরা দৈনিক মজুরী পায় মাত্র ১৫০ টাকা। এছাড়া ১টাকা ৩০পয়সা কেজি হারে সপ্তাহে সাড়ে ৩ কেজি রেশন পায়। অনেক পরিবারে একজন মাত্র উপার্জনক্ষম লোক আছে যাকে পুরো পরিবার চালাতে হয় এত অল্প টাকায় ও রেশনে।

স্থায়ী শ্রমিকেরা বছরে ২০০০-৩৫০০ টাকা বোনাস পায়। কিন্তু যারা ২৬০ দিনের কম কাজ করে তারা বোনাস পায় না। এছাড়া ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করলে শ্রমিকেরা চা পাতার কেজি প্রতি ২ টাকা করে অতিরিক্ত পায়। অস্থায়ী শ্রমিকেরা স্থায়ী শ্রমিকের মতো বেতন পেলেও কোন বোনাস পায় না। কিছু কিছু বাগানে নির্ভরশীল শিশুদের রেশনের সুবিধা থাকলেও অনেক বাগানে এ সুবিধা নেই। শ্রমিকদের থাকার জন্য প্রতি বাগানে কলোনী থাকলেও তা অত্যন্ত নিম্নমানের। অধিকাংশ ঘর বাঁশ ও ছনের তৈরী, কাচাঁ ঘরও আছে অনেকগুলো। প্রতিটি কলোনীতে ২৫-৩০ পরিবার থাকলেও তাদের খাবার পানির সমস্যাও থাকে।

 

এছাড়া স্যানিটেশন ব্যবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। অধিকাংশ বাগানে শিশুদের শিক্ষার তেমন কোন সুযোগ নেই। তবে কয়েকটি বাগানে এনজিওদের প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। নব্বইর দশকে বাগানগুলোতে বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প নেয়া হলেও তা এখনো বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। বাগানগুলোতে চিকিৎসার সুযোগ থাকলেও তা নামেমাত্র। বাগানের মাটি, গাছ ও পাতাকে ভালবেসে শত লাঞ্চনা সয়েও তারা বাগানেই তাদের জীবন কাটিয়ে দেয়। এভাবেই শেষ হয় একজন চা শ্রমিকের জীবন।

চা শ্রমিক চট্টগ্রাম ভ্যালির সাধারণ সম্পাদক যতন কর্মকার বলেন, চট্টগ্রামে প্রথম চায়ের আবাদ শুরু হয় ১৮৪০ সালের দিকে। এখন এ অঞ্চলে চা বাগান রয়েছে ২২টি। এর মধ্যে ১৭টি ফটিকছড়িতে। এসব বাগানে কাজ করেন ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক। বংশ পরম্পরায় কাজ করা এসব শ্রমিক ন্যায্য মজুরি বঞ্চিত।

 

চন্দনাইশ এলাহাবাদস্থ পটিয়া টি এষ্ট্রেটে শ্রমিকদের চিত্র ভয়াবহ। কাঞ্চননগর থেকে ৩ কিলোমিটার পূর্বে গহীন পাহাড়ের পাদদেশে ১৯৩০ সালে টি এষ্ট্রেটটি সৃষ্টি হয়। চা বাগানটি ব্রিটেন ও কানাডীয় দুটি সংস্থা পরিচালনায় ছিল।বর্তমানে বাগানটি বন্ধ হয়ে পড়েছে। ওখানে প্রায় দেড় শতাধিক শ্রমিক পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

 

এদিকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে চট্টগ্রামের ২২টিসহ দেশের ২৪০ চা-বাগানে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন।

 

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, আমরা চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের সকল চা বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। সকল শ্রমিক মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। কারণ বর্তমানে সকল ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। শ্রমিকরা যে মজুরি পান তা দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল। তাই মজুরি না বাড়লে আমাদের শ্রমিকরা আজ থেকে কাজে যোগ দেবে না। চট্টগ্রাম-সিলেটসহ সারাদেশের শ্রমিকরা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত।

বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরামের মহাসচিব আকতার উদ্দিন রানা চট্টলার খবরকে বলেন, সর্বশেষ চুক্তিতে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১০২ টাকা ধরা হয়েছে, যা দেশের অন্য খাতের শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম। আবার ক্যাশ প্যাকিং, নির্ধারিত টার্গেটের অতিরিক্ত পাতা তোলা ও অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য শ্রম আইন অনুযায়ী মূল মজুরির দ্বিগুণ মজুরি দেয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো বাগানেই তা দেয়া হয় না। মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিলে চা শ্রমিকের মজুরি অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে।

ইহ/চখ

এই বিভাগের আরও খবর