chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

সব বাঁধা মাড়িয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের নিরলস ছুটে চলা

 ‍নিলা চাকমা : সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের ৬৫ টি ঘণ্টা পার হয়েছে ইতোমধ্যে। আগুন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখনো শতভাগ নেভানো সম্ভব হয়নি। কিছু কনটেইনারে থেমে থেমে আগুন জ্বলছে। দীর্ঘ এই সময়টাতে খবর জানাতে পথেপ্রান্তে ছুটেছেন সংবাদকর্মীরা। সীমিত সাধ্যের সবটুকু উগড়ে দিয়ে মুহূর্তেই খবর পৌছে দিতে পিছিয়ে ছিলেন না কেউই। নিরলস দায়িত্ব পালন করে গেলেও আজ তারা নেই কোন খবরে।

শনিবার (৪ জুন) রাত ১০ টার দিকে ডিপোতে বিস্ফোরণের সংবাদ পেয়ে ক্যামেরা, ট্রাইপড, বুম (মাইক্রোফোন) হাতে নিয়ে ছুটে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিএম কনটেইনার ডিপোতে।

 

আন্তরিকতা, সাহসিকতা, আর আত্মবিশ্বাসের মিশেলে প্রতিটি সংবাদকর্মী নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। যে দায়িত্ব ঘটনার ৬৫ ঘণ্টা পার হলেও শেষ হয়নি। বিরামহীনভাবে সংবাদকর্মীরা ঘটনার আপডেট জানাতে কাজ করে যাচ্ছেন।

দুর্বিষহ এই সময়টাতে সম্প্রীতির অনন্য নজির দেখিয়েছে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। যার যার অবস্থান থেকে রক্ত, ওষুধ, পানি, শুকনা খবরসহ সাধ্যমত এগিয়ে এসেছে। এ যেন একই ডোরে বাধা সবকটি প্রাণ। তাইতো আহত মানুষগুলোকে একটুখানি ভালো রাখতে প্রাণপনে চেষ্টা করা।

 

বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। প্রাণঘাতী এই কেমিক্যালের তেজস্ক্রিয়া এতটা তীব্র যে দীর্ঘসময় ডিপোটিতে দায়িত্বপালন করা ঝুঁকিপূর্ণ। এর তেজস্ক্রিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করলে তীব্র শ্বাস কষ্ট দেখা দিয়ে মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানায় চিকিৎসকরা। এসব ঝুঁকিকে কোন পরোয়া না করেই সংবাদকর্মীরা কাজ করে গেছেন। দায়িত্বপালন করতে গিয়ে চোখ-মুখ জ্বালা পোড়া, সর্দি, জ্বরে ভুগেছেন বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী।

 

টানা দায়িত্ব পালনে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করে আরটিভির রিপোর্টার মোহাম্মদ নাজিম বলেন, অসুস্থ মা বাবাকে দেখতে বাড়িতে গিয়েছিলাম, হঠাৎ পৌনে এগারটা নাগাদ অফিস থেকে ফোন পেলাম চট্টগ্রাম মেডিকেলে যাওয়ার জন্য। কিছু বুঝে না উঠার আগে পৌনে বারোটা নাগাদ হাসপাতালে প্রবেশ করে আহতদের আর্তনাদ, চিৎকার, স্বজনদের কান্না দেখে বুঝতে পারি কিছু একটা হয়েছে। এরপর কিছু তথ্য সংগ্রহ করে সরাসরি চলে যায় লাইভ সস্প্রচারে। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকালে আবার অফিস করেছি। সেই রাত থেকে এখনও নাওয়া- খাওয়া বাদ দিয়ে কাজ চলছে। পানির পিপাসা লাগে তখন সেচ্ছাসেবী কোনো সংগঠনের সদস্য কাছ থেকে পানি চেয়ে নিই। এভাবে আমার অন্য সহকর্মীরাও মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন।

 

টিভি জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও দীপ্ত টেলিভিশন চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান লতিফা আনসারী রুনা বলেন, সারাদিন অফিস করে রাতে খেতে বসছি। খাবারটুকু মাত্র মুখে তুলে নিলাম এমন সময় খবর এলো সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ হয়েছে। তখন রাত ১১টা ১০ এর মত। ওই অবস্থায় বুমটা সাথে নিয়ে ক্যামেরা পার্সনসহ মেডিকেলে চলে যাই। এটি ছিলো আমার স্মরনীয় এসাইনমেন্ট। একটানা এক ঘণ্টা তিন লাইভ সম্প্রচারে ছিলাম। সারারাত কেটেছে মেডিকেলে। পরদিন সকালে বিএম ডিপোতে যাই। সেখানেও লাইভ সম্প্রচারে যুক্ত হই। বিএম ডিপোতে গিয়ে ওখানকার কিছু ছেলে-পেলেদের দ্বারা বিরূপ আচরনের শিকার হই। তারা নানা মন্তব্য করতে থাকে। আমাকে ভিডিও করতে থাকে। তারপরও নিজের দায়িত্বটুকু পালন করি। আসলে আমরা যারা সাংবাদিকতা করি আমরা এটাকে শুধুমাত্র একটি পেশা হিসেবে কখনো দেখি না। আমরা আমাদের কাজকে দায়িত্ব হিসেবে নিই। আর এমন ঘটনায় তো অবশ্যই দায়িত্ব হিসেবে নিতে হয়। দায়িত্ব মনে করতে না পারলে ডেডিকেশন আসবে না। কাজও হবে না। কাজ করতে গিয়ে জনসাধারন ও প্রশাসনের সহায়তা চাই। আমরা ঘটনাস্থলে ছুটে যাই দায়িত্বপালন করতে। নিজেদের কোন স্বার্থে নয়।

 

নিউজনাউ টোয়েন্টিফোর ডটকমের চট্টগ্রাম ব্যুরো পার্থ প্রতীম নন্দী চট্টলা খবরকে বলেন, আমার সাংবাদিকতার জীবনে এটি ভয়াবহ স্মরণীয় একটি রাত। যখন বিস্ফোরণে নিহত-দগ্ধদের সর্বশেষ সংবাদ লাইভে জানাচ্ছিলাম তখনই স্বেচ্ছাসেবকদের হ্যান্ডমাইকে ভেসে আসছিল রক্ত লাগার খবর। তারা বলছিলেন ও নেগেটিভ রক্তের বেশি প্রয়োজন। আমি নিজে এই রক্তের বাহক হওয়ায় খুব অস্থির লাগছিল। আবার রক্ত দেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে আমার কাজ চালিয়ে যেতে পারব কিনা সেটাও ভাবছিলাম। আমি ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে নাম জমা দিয়ে এসেছিলাম। যদিও পরে আমাকে আর কল দেয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের চেষ্টা থাকে এমন ঘটনাগুলার সর্বশেষ তথ্যের অবশ্যই সঠিক বর্ণনা জনগণকে জানানো। কিন্তু সবসময় সেটা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে এই রকমের বড় কোন ঘটনায়। তবে এই সীতাকুণ্ড ট্রাজেডিক আবার করতে গিয়ে আমরা দেখেছি সংবাদ মাধ্যমগুলো ছিল প্রায় শতভাগ নির্ভুল। এইদিনে আমরা দেখছি সংকটে ঐক্যবদ্ধ চট্টগ্রামের শক্তি ঠিক কতটা শক্তিশালী। তারুণ্যের পাশাপাশি ‘বয়সে বুড়ো চিন্তায় তরুণ’ এমন অনেক মানুষ সারা রাত কাজ করেছেন।

 

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে নয়জন ফায়ার সার্ভিসের সদস্য। এছাড়া তাদের তিনজন সদস্য নিখোঁজ।

এমএইচকে/চখ/নচ

এই বিভাগের আরও খবর